সেদিন ওয়াজিহার বাসায় গিয়েছিলাম। অনেকদিন তার সাথে দেখা হয়না, ওর বাসার আশেপাশেই কিছু কাজে আসায় ভাবলাম দেখা করে যাই। অনেকটা উৎসাহী ছিলাম,ওয়াজিহা আমাকে হঠাৎ করে দেখে নিশ্চয়ই খুব সারপ্রাইজ হবে! অনেক খুশিও হবে বটে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ওয়াজিহার বাসার কলিং বেল বাজালাম।
কিছুক্ষন পর ওয়াজিহার বাসার হেল্পিং হ্যান্ড দরজা খুললো। একটু অবাক হয়ে বললাম ওয়াজিহা নেই? খালা মুখটা বিমর্ষ করে বললো, ভেতরে আসেন আপামনি। আমি ভাবনার গভীরে থেকে ধীরে ধীরে ভেতরে গেলাম। বসার ঘরে গিয়ে বসতেই আন্টি, মানে ওয়াজিহার আম্মু এসে দাঁড়ালো, আন্টিকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিল কিছু একটা উনার জীবনের সব কিছুকে গ্রাস করে নিয়েছে। আন্টির সাথে কথা বলতে থাকলাম, একটা পর্যায়ে তার জীবনে নেমে আসা ঘন কালো কুয়াশার কারণ খুঁজে পেলাম আর যা পেলাম তা ছিলো আমার জন্যও একটা ধাক্কা।
ওয়াজিহা আমার ছোট্ট বেলার সাথী,পড়াশোনার তাগিদে দুজনের একসাথে চলার রাস্তা একটু ভিন্ন হয়। কিন্তু ওয়াজিহার এমন কিছু শুনবো বা দেখবো তা যেন আমার জন্য এক দুঃসপ্ন ওয়াজিহা লেখাপড়ায় অনেক ভালো, তার বিচক্ষনতার,তার সৃজনশীলতা, কিংবা দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে কিছু অর্জন করার ইচ্ছাশক্তি ছিলো প্রবল। আন্টি বলেন, দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ওয়াজিহা একদম নিজের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে, তার কোনো কিছুই ভালো লাগেনা, কোন কাজ করতে সে আর আগ্রহ পায়না, আশেপাশের কারো সাথে তেমন কথা বলেনা, ঘুমায়না যেন কতরাত!
তার ক্লাসমেটরা তাকে বাইরে বের করার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন চেষ্টায় সফল হয়নি। আন্টি আরও বলে, আমার সেই ওয়াজিহা আর নেই রে মা, যে মেয়ে আমার এতো মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতো সে এখন টেবিলের সেই গোছানো বই গুলোর দিকেও আর তাকায় না। আন্টি এক নাগাড়ে কথা গুলো বলছিলে আর তার শুখিয়ে যাওয়া চোখের পাতাগুলো ভিজে আসছিলো বারে বার।
এবার আন্টিকে একটু থামিয়ে দিয়ে তার হাতটা ধরে বললাম চাচী ওয়াজিহা কে কোন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন? চাচী বললো কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো মা? আমি একা মানুষ, আর আমার মেয়েটার যে কি হয়েছে এটাই তো আমি বুঝে উঠতে পারছিনা, কোন ডাক্তারের কাছে নিব তাই জানিও না।
চাচী কে বললাম আপনি এতো ভেঙ্গে পড়েননা, ওয়াজিহার যে সমস্যা হয়েছে তা নিরাময় যোগ্য। (একথা বলতেই চাচী যেন ধুধু মরুভূমিতে এক বুদ পানির ফোয়ারা খুঁজে পেল! চাচী খুব উত্তেজিত আর আগ্রহী হয়ে বললো তুমি সত্যি বলছো মা? আমার ওয়াজিহা আবার আগের মত ঠিক হয়ে যাবে?)
আমি বললাম হ্যা চাচী, ওয়াজিহা যে সমস্যাই ভুগছে তা একটা মানসিক ডিসঅর্ডার। (চাচী ঘাবড়ে গেলো), চাচী এটা অনেকেরই হয়ে থাকে, কিন্তু ঘাবড়ে যাবার মত কিছু নয় উপযুক্ত সময় চিকিৎসা শুরু করলে বড় জটিলতা আসার আগেই এটা নিরাময় করা যাবে। এই ডিসঅর্ডার কে বলা হয় MDD বা (মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার)।
এই ডিসঅর্ডারের এর লক্ষন গুলো –
- বিষন্ন মেজাজ
- আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা -অনিদ্রা বা অতিরিক্ত ঘুম। (প্রায় প্রতিদিন)
- ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস
- অপরাধবোধ
- মৃত্যু বা আত্মহত্যার চেষ্টা (মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি চিন্তা। (শুধু মৃত্যুর ভয় নয়), নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই বারবার আত্মহত্যার ধারণা বা আত্মহত্যার চেষ্টা, বা আত্নহত্যার জন্য নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা)।
এই লক্ষন গুলির মধ্যে ৫টির বেশি বা অন্তত একটি বিষন্ন মেজাজ বা আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা দু’ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেখলে মানসিক চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ এবং সাইকোথেরাপিস্টের দিকনির্দেশনা মূলক সহযোগিতার মাধ্যমে এই ধরনের মানসিক সমস্যা দূর করা সম্ভব হয় ইং শা আল্লাহ ।
এতোক্ষনে ওয়াজিহার আম্মুর চোখে মুখে যেনো আশার আলো দেখা গেলো। আন্টিকে বললাম চলেন ওয়াজিহার কাছে যাই আর আমার পরিচিত চিকিৎসক আছেন আজকেই আমরা সেখানে যাবো।
আরো দেখুন
বোবাই ধরা বা Sleep Paralysis কি?
Farhana Jesmin Joba
Department of clinical psychology, Rajshahi University
Intern Clinical psychologist, Rangpur medical College and Hospital